ঢেউটিন কিভাবে তৈরি হয় ? 

পেজটি শেয়ার করতে ক্লিক করুন।

Facebook
WhatsApp
Skype
Telegram

ঢেউটিন, বা বাংলাদেশে পরিচিত ঢেউ খেলানো টিন, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বহুল ব্যবহৃত একটি নির্মাণ সামগ্রী। এই দৃঢ় ও টেকসই ঢেউটিন কিভাবে তৈরি হয়, সে সম্পর্কে কি আপনার জানা আছে?

১. ঢেউটিনের কাচামাল

ঢেউটিন তৈরির মূল কাঁচামাল হলো হট রোল্ড (HR) কয়েল। এটি মোটামুটি পুরুত্ব (প্রায় ২ মিলিমিটার) ইস্পাতের চাদর।

বাংলাদেশে ব্যবহৃত বেশিরভাগ কাচামাল কয়েল বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। এর মূল কারণ হলো বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত বড় আকারের ইস্পাত কারখানা নেই যা এই ধরণের কয়েল উৎপাদন করতে পারে।

আমদানিকারী দেশগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:

  • চীন: বর্তমানে বাংলাদেশের কাচামাল কয়েলের প্রধান সরবরাহকারী।
  • জাপান: উচ্চমানের কয়েলের জন্য পরিচিত।
  • দক্ষিণ কোরিয়া: উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে কয়েল উৎপাদন করে।
  • ভারত: বাংলাদেশের কাছাকাছি অবস্থিত এবং তুলনামূলকভাবে কম দামে কয়েল সরবরাহ করে।
  • রাশিয়া: ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বর্তমানে আমদানি কমেছে।

আমদানিকৃত কয়েলের ধরণ:

  • হট রোল্ড (HR) কয়েল: এটি সবচেয়ে প্রচলিত ধরণের কয়েল।
  • কোল্ড রোল্ড (CR) কয়েল: HR কয়েলকে আরও পাতলা ও মসৃণ করে তৈরি করা হয়।
  • গ্যালভানাইজড কয়েল: জিংকের প্রলেপ দেওয়া কয়েল, যা একে জারা থেকে রক্ষা করে।

কয়েল আমদানির প্রক্রিয়া:

  • আমদানিকারীরা বিদেশী সরবরাহকারীদের সাথে যোগাযোগ করে কয়েল অর্ডার করে।
  • কয়েলগুলো জাহাজে করে বাংলাদেশের বন্দরে আনা হয়।
  • বন্দর থেকে কয়েলগুলো কারখানায় সরবরাহ করা হয়।

বাংলাদেশে কাচামাল কয়েলের চাহিদা:

বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে নির্মাণ শিল্পে কাচামাল কয়েলের চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যার ফলে কয়েলের চাহিদা আরও বেড়েছে।

২. টিন বানানোর প্রস্তুতি

  • প্রথমে HR কয়েলকে পিকলিং প্ল্যান্টে নানা রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে পরিষ্কার করা হয়, যাতে ধুলো, ময়লা ও অক্সাইডের মতো অপদ্রব্য দূর হয়।
  • তারপর একে প্রচণ্ড চাপে বেলনার মধ্য দিয়ে চালনা করা হয়, যা কয়েলের পুরুত্ব কমিয়ে এবং দৈর্ঘ্য বাড়িয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়াটির ফলে সিওল্ড রোল্ড (CR) কয়েল তৈরি হয়।

mpc hc64 JG7KPzSJm4
সিওল্ড রোল্ড (CR) কয়েল তৈরি হচ্ছে

৩. গ্যালভানাইজিং:

  • টেকসই করার জন্য CR কয়েলকে জিংকের প্রলেপ দেওয়া হয়। এটি সাধারণত দুই ভাবে করা হয়: হট ডিপ গ্যালভানাইজিং এবং কনটিনিউয়াস গ্যালভানাইজিং।
  • হট ডিপ গ্যালভানাইজেশনে কয়েলকে গলিত জিংকের টানকে ডুবিয়ে রাখা হয়। কনটিনিউয়াস গ্যালভানাইজিংয়ে জিংকের গলিত স্তরের মধ্য দিয়ে কয়েল চালনা করা হয়।

brave V2RQolKrYz
জিংক এর পুকুর থেকে তুলা হচ্ছে।

৪. ঢেউ তৈরি:

  • প্রলেপ দেওয়া কয়েলকে বিশেষ রোলারের মধ্য দিয়ে চালনা করা হয়, যা এর পৃষ্ঠে সমান্তরাল ঢেউ তৈরি করে। এই ঢেউ টিনের শক্তি ও দৃঢ়তা বাড়িয়ে দেয়।

৫. কাটাছাঁটা ও চূড়ান্ত পর্যায়:

  1. ঢেউ খেলানো কয়েলকে প্রয়োজনীয় দৈর্ঘ্য ও আকারে কাটা হয়।
  2. এরপর প্রান্তগুলোকে মসৃণ ও নিরাপদ করার জন্য বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়।

৫.১ কাটাছাঁটা:

  • ঢেউ খেলানো কয়েলকে প্রথমে প্রয়োজনীয় দৈর্ঘ্য ও আকারে কাটা হয়। এটি সাধারণত দুটি পদ্ধতিতে করা হয়:
    • শিয়ারিং: এতে ধারালো ব্লেড ব্যবহার করে কয়েলকে কাটা হয়।
    • সার্কুলার সো: এতে ঘূর্ণায়মান ব্লেড ব্যবহার করে কয়েলকে কাটা হয়।

৫.২ প্রান্ত প্রক্রিয়াজাতকরণ:

  • কাটার পর ঢেউটিনের প্রান্তগুলো তীক্ষ্ণ ও ধারালো থাকে। এগুলোকে মসৃণ ও নিরাপদ করার জন্য বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়।
  • এই প্রক্রিয়ায় প্রান্তগুলোকে:
    • ডি-বার্ডিং: ধারালো প্রান্তগুলোকে মসৃণ করা হয়।
    • কোটিং: প্রান্তগুলোকে রঙ, পলিমার, বা অন্য কোন প্রতিরক্ষামূলক প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।

৫.৩ চূড়ান্ত পর্যায়:

  • ঢেউটিনের উপর প্রয়োজনে রঙ বা অন্য কোন প্রলেপ দেওয়া হয়।
  • ঢেউটিনগুলোকে গুচ্ছ করে বাজারজাত করা হয়।

আরও কিছু তথ্য:

  • ঢেউটিনের বিভিন্ন রঙ ও প্রলেপ বাজারে পাওয়া যায়।
  • ঢেউটিনের পুরুত্ব, ঢেউয়ের আকার ও প্রলেপের ধরণ অনুযায়ী এর দাম নির্ধারণ করা হয়।
  • ঢেউটিন দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই একটি নির্মাণ সামগ্রী।
  • ঢেউটিন ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরণের স্থাপনা তৈরি করা সম্ভব।

উপরের ছবিগুলো PHP পিএইচপি এরাবিয়ান হর্স ফ্যাক্টরি থেকে নেয়া। ছবিগুলো দিয়ে সাহায্য করেছেন Rafiqul Baha স্যার ধন্যবাদ ছবিগুলো ব্যবহার এর অনুমতি দেবার জন্য।

ঢেউটিন তৈরি সম্পর্কে নতুন তথ্য:

১. টেকনোলজির অগ্রগতি:

  • ঢেউটিন তৈরির প্রক্রিয়া দ্রুত ও উন্নত করার জন্য নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।
  • অটোমেশন ও রোবোটিক্স ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
  • কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত মেশিন ঢেউটিনের গুণমান উন্নত করতে সাহায্য করছে।

২. পরিবেশগত দিক:

  • ঢেউটিন উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
  • পরিবেশ দূষণ কমাতে উৎপাদকরা নতুন নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে।
  • রিসাইকেল করা কাঁচামাল ব্যবহার ও শক্তির দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

৩. নতুন ধরণের ঢেউটিন:

  • বিভিন্ন ধরণের চাহিদা পূরণ করার জন্য নতুন নতুন ধরণের ঢেউটিন বাজারে আসছে।
  • উন্নত প্রলেপ ও উপাদান ব্যবহার করে ঢেউটিনের দীর্ঘস্থায়িত্ব ও কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
  • শক্তি-সাশ্রয়ী ও অগ্নিনির্বাপক ঢেউটিন বাজারে জনপ্রিয়তা লাভ করছে।

৪. ঢেউটিনের ব্যবহারের নতুন ক্ষেত্র:

  • ঢেউটিন শুধুমাত্র ছাদ ও বেড়া তৈরির জন্য ব্যবহার করা হত।
  • বর্তমানে ঢেউটিন বিভিন্ন নতুন নতুন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে।
  • ফার্নিচার, শিল্পকর্ম, ও ভাস্কর্য তৈরিতে ঢেউটিন ব্যবহার করা হচ্ছে।

৫. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট:

  • বাংলাদেশে ঢেউটিন একটি জনপ্রিয় নির্মাণ সামগ্রী।
  • দেশে বেশ কিছু ঢেউটিন উৎপাদনকারী কারখানা রয়েছে।
  • স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি ঢেউটিন বিদেশেও রপ্তানি করা হচ্ছে।

উপসংহার:

ঢেউটিন তৈরির প্রক্রিয়া ক্রমশ উন্নত হচ্ছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি ও ধরণের ঢেউটিন বাজারে আসছে। ঢেউটিনের ব্যবহারের ক্ষেত্রও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে ঢেউটিন শিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।

Source গুগল ডাটাবেজ